পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু আছে - জিনিয়াস ২৪ বিডি

নতুন কিছু জানতে সব সময় চোখ রাখুন

Smiley face

সর্বশেষ

Home Top Ad

For add : 01689145308

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Sunday 18 February 2018

পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু আছে




জেসমিন চৌধুরী 

গতবছর পহেলা ফাল্গুনে চারটা লাইন লিখেছিলাম
'ফাগুন এলেই আগুন জ্বলে দ্বিগুণ আমার মনে।
অযুত মেয়ের নিযুত ফাগুন হারিয়ে গেছে রণে।'


জীবনে দীর্ঘ শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে যখন ফাল্গুন কোন দিক দিয়ে এসেছে গিয়েছে, কোকিল গেয়েছে কী না সেই খোঁজ রাখার মত মানসিক অবস্থা ছিল না। আজ আমার স্বনিয়ন্ত্রিত জীবনে প্রতিটি দিনই ফাল্গুন, প্রতিটি দিনই ভালোবাসা দিবস কিন্তু সেইসব সুদীর্ঘ শীতময় দিনের কথা আমি ভুলিনি। আরো অসংখ্য মানুষের জীবনে যে পুষ্পহীন ফাল্গুন এসেছে আজ, প্রতিবারই আসে, সেকথা আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে? বসন্ত কি শীতের স্মৃতি মুছে দিতে পারে? ‘পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে রিক্ত হস্তে’ চলে গেছে যে ‘মাঘের সন্ন্যাসী’ তার স্মৃতি আমার বসন্তকে বরাবারই ব্যাথাতুর করে তোলে।
প্রেম ভালোবাসা কাকে বলে তা বুঝবার আগেই সমাজের কারাগারে অল্পবয়সে বন্দী হয়ে পড়া আমার কোলে এসেছিল প্রথম সন্তান, তুলতুলে ভালোবাসার বান্ডিল ফুটফুটে একটা ছেলে। তার হাসি, আধো আধো কথা, ধমক খেয়ে ঠোঁট ফোলানো কান্নায় আমার বুকটা ব্যাথামিশ্রিত ভালোবাসায় টনটন করে উঠত। চুলে-পিঠে বৃদ্ধ মায়ের চামড়া কুঁচকে যাওয়া হাতের বিলিকাটা মমতা আর দিনভর ছেলের ছোট্ট হাতের আদরের বাইরে অন্য কোনো ভালোবাসা কেমন হয় তা জানার সুযোগ তখনো আমার হয়নি।    
স্বামীকে ভালোবাসতাম না, বাসতে পারিনি। চেষ্টা করিনি এমন নয়। নিজেকে বুঝিয়েছি- তাকে ভালোবাসা আমার কর্তব্য, স্বামীকে ভালোবাসতেই হবে। ভালবাসবার মত কী কী গুণ তার আছে তার তালিকাও তৈরি করেছি বারবার, তাকে নিয়ে ছেলেমানুষি ভালোবাসার কবিতাও লিখেছি। জোর করে যে এসব হয় না তা বুঝতে খুব বেশী দেরি না হলেও ততদিনে ক্লান্ত অথচ অভ্যস্ত হয়ে গেছি ভালোবাসাহীন জীবনে।  
বাচ্চাদের জন্য দুধ কিনতে দোকানে গিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফুলে, উপহারে, সৌরভে উপচে পড়া তাকগুলোর দিকে। এইসব উপহার কারা কেনে? কারা পায়? তারা কেমন লোক? কেমন তাদের জীবন? বইয়ে পড়া, সিনেমায় দেখা ভালোবাসার গল্পগুলো দেহে মনে এক অদ্ভূত শিহরণ এনে দিতো, ভালোবাসতে চাওয়ার এক অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষায় মনটা হুহু করে উঠত।  না পাওয়ার নয়, বরং চাইতে না পারার এক ভীষণ কষ্ট অনুভূতিকে অবশ করে দিত। সেইসাথে এইসব ভাবনার জন্য এক তীব্র অপরাধবোধ- আমি কি বাজে মেয়ে?  
দেখতে ভালো ছিলাম, স্বভাবে চঞ্চল, কথাবার্তায় চটপটে। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম সহজেই কিন্তু আমার দৃষ্টি কি আকর্ষণ করত কেউ? সামাজিক নিয়ম কানুনের দ্বারা আশৈশব কন্ডিশন্ড আমার ‘চরিত্র যে ফুলের মত পবিত্র’ হতেই হবে, তা কি আমি জানতাম না? দুই বাচ্চার তরুণী একজন মা বিবাহিত জীবনে যত অসুখীই হোক না কেন, তার সুখহীন জীবনের দায়ভার যারই হোক না কেন, ভারটা বইবার দায়টা যে তার নিজেরই! ফাল্গুন  অথবা ভালোবাসা দিবস এলে আর গেলে তার কী বা আসে যায়? সে ভালো মেয়ে। সন্তানের চাহিদা কীভাবে পূরণ করবে, স্বামীর কারণে-অকারণে চড়ে যাওয়া মেজাজ কীভাবে শান্ত রাখবে, কীভাবে জীবন বাঁচলে দশজনের অনুমোদন পাওয়া যাবে এইসব ভাবনায় তার প্রেমহীন জীবন কেটে যায়।
মেয়ের জন্মের পর ড্রাইভিং শিখতে গেলাম, প্রশিক্ষক আমার চেয়েও বয়সে বছরখানেকের ছোট ইংরেজ একটা ছেলে, নাম ড্যানি। কী মোলায়েম তার কন্ঠস্বর! কী অসম্ভব ভদ্র তার আচরণ! এই প্রথম একজন পুরুষ আমার সাথে এতোটা সম্মানের সাথে কথা বলছে, যেন আমি আসলেই একটা মানুষ। দ্বিতীয় দিনেই একটা বাসের সাথে সংঘর্ষ লেগে তার গাড়িটা রাইট-অফ হয়ে গেল। ড্যানি বেরিয়ে গেল গাড়ির অবস্থা নিরীক্ষণ করতে।  সারাজীবন কারণে অকারণে ধমক খাওয়া আমি যখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছি সে ফিরে এসে হেসে বলল, ‘ইউ হ্যাভ ডান মি আ হিউজ ফেভার। নাউ দ্য কোম্পেনি ইউল গিভ মি আ নিউ কার’।
তার ভদ্রতার কারণ হয়ে থাকতে পারে তার পেশাদারিত্ব, তার প্রশিক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমি তখন এসবের কী বুঝি? ঘরের বাইরে এই প্রথম একজন পুরুষের সাথে আমার এতো দীর্ঘ সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা এবং পুরুষটি অস্বাভাবিক রকমের ভদ্র যা আমি আগে কখনো দেখিনি। সপ্তাহের সেই বিশেষ দিনটির অপেক্ষা থাকত যখন ড্যানি এসে আমাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে যাবে একটি ঘন্টার সুন্দর সময়ের জন্য যখন স্টিয়ারিং থাকবে আমার হাতে, পাশে বসা পুরুষটা আমাকে সারাক্ষণ ধমকাবে না। ড্রাইভিং শেখা শেষ হয়ে গেলে একদিকে সাফল্যের আনন্দ আবার অন্যদিকে সাপ্তাহিক সুন্দর সময় কাটানোর অবসানে মন খারাপ লাগতে লাগল।  আমি কি ড্যানির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম? এখন বুঝি ওটা ছিল মুক্তির আনন্দ। যে মেয়ের জীবনে মুক্তিই নেই, তার আবার প্রেম কীসের?  
তবে প্রায়ই ভাবতাম, আমার স্বামীটা ড্যানির মত হলে কী অসাধারণ একটা ব্যাপার হতো! কারো বাসায় বেড়াতে গিয়ে খুব নরম স্বভাবের পুরুষ দেখলে ভাবতাম আমার স্বামীটা তো এমন হলেও পারত! কোনো পুরুষের বই/কবিতা পড়ার অভ্যাস আছে দেখলে আমার আক্ষেপ হতো, আহা আমার স্বামীটা যদি অন্তত বইও পড়ত! কোনো পুরুষের সাথে তার বাচ্চাদের সুন্দর সম্পর্কে দেখলেও তার প্রতি একধরনের দুর্বলতা অনুভব করতাম। আমার এক সহকর্মী সারাক্ষণ মজা করে কথা বলতেন, তার বাসার সবগুলো দেয়াল ঢাকা ছিল বাচ্চাদের হাতের শিল্পকর্মে যা নিয়ে তার কোনো বিকারই ছিল না। অদৃশ্য সব ক্ষমতার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল আমার স্বামীটা এমন হলে কার কী ক্ষতি ছিল?
জীবনের মোড়ে মোড়ে এমন অনেক পুরুষকেই দেখেছি যাদের মধ্যে ছোট্ট কোনো গুণ দেখে ভীষণ আক্ষেপ হয়েছে, আমার পুরুষটি এমন নয় কেন?  এ কি প্রেম? প্রেম কি এতোই সহজ? এদেরকে আমি কতটুকুই বা চিনতাম?
এক পর্যায়ে এসে যখন এই আক্ষেপময় জীবন থেকে মুক্ত হতে পারলাম, তারপর থেকে আমার জীবনের প্রতিটি দিনই ফাল্গুনের মত সুন্দর হয়ে উঠল সত্যি, কিন্তু সেইসাথে এক নতুন উপলব্ধি- আসলে ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’। অন্যের স্বামীদের টুকটাক গুণ দেখে একমুহুর্ত আক্ষেপ করা যত সহজ কারো হাত ধরা তত সহজ না, প্রেমে পড়াও অত সহজ না।
তারপর এক বর্ষার দিনে আমার জীবনে হুড়মুড় করে বসন্ত এসে হাজির, সেই সাথে প্রেম। লোকটা বই পড়ে, কবিতা পড়ে, নাটক করে, ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা, নিজের বাচ্চাদের সাথে অসম্ভব সুন্দর সম্পর্ক, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী- আমার দেখা সব নারীর সব স্বামীর সব গুণাবলী একত্রিত হয়ে আমার সামনে উপস্থিত।
কে যেন বলেছিল, সঠিক মানুষের সাথে থাকলে জীবনের প্রতিটি দিনই ভালোবাসা দিবস। কথাটা সত্যি। তার সাথে জুড়ে দিতে চাই, ভুল মানুষের সাথে থাকলে জীবনের প্রতিটি দিনই পুষ্পবিহীন কঠিন শীত। সবাই সঠিক মানুষটিকে খুঁজে নিতে সক্ষম হোক, জোর করে চাপিয়ে দেয়া শীতল প্রেমহীন সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাক পৃথিবী- এবারের ফাল্গুনে এই আমার প্রার্থনা।
জেসমিন চৌধুরী : অভিবাসী শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক; ম্যানচেস্টার, ইউকে।

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here
Top