ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - জিনিয়াস ২৪ বিডি

নতুন কিছু জানতে সব সময় চোখ রাখুন

Smiley face

সর্বশেষ

Home Top Ad

For add : 01689145308

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Sunday 29 January 2017

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ–

চলতি নাম সিপাহি বিদ্রোহ বা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ। ঐতিহাসিকেরা বলেন, আমাদের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ। ভারতকে স্বাধীন করতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যতগুলি সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আমরা গড়ে তুলেছিলাম, তার মধ্যে এই বিদ্রোহই ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণময় ঘটনা। যদিও এই যুদ্ধ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র অভ্যুত্থান নয়। এর আগে একাধিক বার একাধিক জায়গায় সংগঠিত বা অসংগঠিতভাবে নানা ছোটোখাটো কৃষক, আদিবাসী ও সেনাবিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে মিরাটের বিদ্রোহ ও তারপর দিল্লি দখলই প্রথম সারা উত্তর ভারতব্যাপী সিপাহি বিদ্রোহের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। সময়টা ছিল ১৮৫৭ সালের গ্রীষ্ম। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিম ও মধ্য ভারতেও। কেবলমাত্র দক্ষিণ ভারত বিদ্রোহের উত্তেজনা থেকে মুক্ত থাকে; পাঞ্জাব ও বাংলায় খুব সামান্য প্রভাবিত হয়। সেই সময় কোম্পানির ২,৩২,২২৪ জন দেশি সিপাহির অর্ধাংশই বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধই প্রথম ভারতকে বিদেশি শাসনের কবলমুক্ত করার প্রেরণা দেয়। বিদ্রোহের একটি ইতিবাচক দিক ছিল দিল্লি দখল করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘শাহেনশাহ্-এ-হিন্দুস্তান’ বা ভারতসম্রাট ঘোষণা করা। এর মাধ্যমে বহুধাবিদীর্ণ ভারতকে পুনরায় একসূত্রে বাঁধার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়, পরবর্তীকালে ভারত যে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তার বীজ নিহিত ছিল এই প্রয়াসের মধ্যেই।

আসলে মহাবিদ্রোহ ছিল একশো বছরের কোম্পানি-শাসনের বিরুদ্ধে একটু একটু করে জমে ওঠা ক্ষোভের হঠাৎ-বিস্ফোরণ। কোম্পানির আর্থিক শোষণ, একচেটিয়া ভূমিরাজস্ব নীতি, আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থা, ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণা ও বর্ণবিদ্বেষ, নানা আছিলা ও প্রকারে একের পর এক দেশীয় রাজ্যগ্রাস ছিল এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মূল কারণ। আর সিপাহিদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ ছিল সেনাবাহিনীতে তাদের দুরবস্থা। তার উপর এনফিল্ড রাইফেল প্রবর্তনের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মনাশ করার প্রচেষ্টার গুজব তাদের তাতিয়ে দেয়। তাতে ইন্ধন জোগায় খ্রিস্টান মিশনারিদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কর্মসূচি।
১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ড্যে নামে ৩৪ নং রেজিমেন্টের এক সিপাহি কুচকাওয়াজের সময় দুই ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যা করেন। উপস্থিত অন্যান্য ভারতীয় সিপাহিরা মঙ্গল পাণ্ড্যেকে গ্রেফতার করতে অস্বীকার করে। পরে অবশ্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাঁর হয় ফাঁসি। কিন্তু এই খবর ছড়িয়ে পড়ামাত্র লখনউ, আম্বালা, বেরহামপুর ও মিরাটের ক্যান্টনমেন্টগুলিতে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। সেই বছরই ১০ মে তারিখে মিরাটের সিপাহিরা এনফিল্ড রাইফেলের বিতর্কিত টোটা (যাতে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো থাকত বলে গুজব রটে) স্পর্শ করতে অস্বীকার করে। একদল বহিরাগতের সাহায্যে সিপাহিরা আক্রমণ করে ইংরেজদের। তাদের মুখে স্লোগান ছিল ‘মারো ফিরঙ্গি কো’। তারা জেল ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করে আনে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে ইউরোপীয়দের হত্যা করে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারপর অগ্রসর হয় দিল্লির পথে। পরদিন সকালে দিল্লির পথে সেই সিপাহিদের দেখে স্থানীয় সিপাহিরাও বিদ্রোহে যোগ দেয়। বক্ত খানের নেতৃত্বে তারা দখল করে নেয় ভারতের এই শতাব্দীপ্রাচীন রাজধানী। অশীতিপর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারত-সম্রাট বলে ঘোষণা করে।

দিল্লি দখলের একমাসের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে কানপুর, লখনউ, বারাণসী, এলাহাবাদ, বরেলি, জগদীশপুর ও ঝাঁসিতে। অবশ্য এই সব অঞ্চলে সামরিক নেতার অভাবে সিপাহিরা ভারতীয় সমাজের স্থানীয় নেতৃবর্গের অধীনেই বিদ্রোহ করে। কানপুরের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন শেষ পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানাসাহেব ও তাঁর বিশ্বস্ত সেনানায়ক তাঁতিয়া টোপি। ঝাঁসিতে রানি লক্ষ্মীবাই, লখনউতে বেগম হজরত মহল ও প্রাক্তন নবাবের উপদেষ্টা আহমদউল্লাহ ও বরেলিতে খান বাহাদুর খান নেতৃত্ব দেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন: অযোধ্যার আহমেদউল্লাহ; জগদীশপুরের রাও সিং, আজিমুল্লাহ্ খান ও কানওয়ার সিং; এবং ফিরোজাবাদের ফিরোজ শাহ ও মৌলবি আহমেদ শাহ।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এঁদের এক করেছিল। যদিও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা এঁদের ছিল না। অতীতের ভারতীয় রাজতন্ত্রকেই এঁরা মনে করেছিলেন শ্রেয়স্কর। বিশেষত, নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের অভাবই বিদ্রোহকে ব্যর্থতার পথে ঠেলে দিয়েছিল। বিদ্রোহের উপর সবচেয়ে বড়ো আঘাতটি নেমে আসে ১৮৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এই দিন ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লি পুনর্দখল করে সম্রাট বাহাদুর শাহকে কারারুদ্ধ করে। এরপর একের পর এক কেন্দ্রে বিদ্রোহীদের পরাজয় ঘটতে থাকে। ১৮৫৮ সালের ১৭ জুন রানি লক্ষ্মীবাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রণক্ষেত্রেই প্রাণ দেন। ১৮৫৮ সালের মে মাসে কানোয়ার সিং ব্রিটিশদের হাত এড়িয়ে পালাতে গিয়ে মারা পড়েন। নানাসাহেব যুদ্ধ চালিয়ে যান। শেষে ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন করে শক্তিসঞ্চয়ের আশা নিয়ে পালিয়ে যান নেপালে। তাঁতিয়া টোপি ১৮৫৯ সালের মে মাস পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও শেষে এক সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। শুধুমাত্র সিপাহি যোদ্ধাদের পরাজয়ই নয়, বিদ্রোহের ব্যর্থতার পিছনে অন্যান্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সিন্ধিয়া, হোলকর ও নিজামের মতো রাজন্যবর্গের বিদ্রোহে না যোগদান এবং সিপাহিদের সঙ্গে স্থানীয় কৃষক, জমিদার ও অন্যান্য শ্রেণির মানুষের সমন্বয়ের অভাবও।

তবে এই বিদ্রোহের একটি ইতিবাচক দিকই অবশ্য উল্লেখনীয়। মহাবিদ্রোহ আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের ভেদ অনেকটাই ঘুচিয়ে দিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা একযোগে বিদ্রোহে অংশ নেয় এবং একবাক্যে বাহাদুর শাহকে সম্রাট হিসেবে মেনে নেয়। তাছাড়া, এই বিদ্রোহীরাই প্রথম সার্থকভাবে আমাদের মনে ইংরেজ-বিরোধিতার বীজ রোপণ করতে সক্ষম হয়।

ভারত সরকার আইন, ১৮৫৮

মহাবিদ্রোহের একটি তাৎক্ষণিক ফল ছিল ১৮৫৮ সালের ভারত সরকার আইন। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ভারত কার্যত শাসিত হত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা। কিন্তু এই আইনবলে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির হাত থেকে কেড়ে নিল সেই ক্ষমতা। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর রানি ভিক্টোরিয়া একটি সনদ জারি করে আমাদের আনলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনে। দেশে একজন ভাইসরয় বা রাজ-প্রতিনিধি নিযুক্ত হলেন। ব্রিটিশ সরকার যে মহাবিদ্রোহের কারণগুলি থেকে যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, তা স্পষ্ট হয়ে গেল রানির এই ঘোষণা পত্রেই। ভিক্টোরিয়া সকল দেশীয় রাজাকে পুত্রসন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। উল্লেখ্য, এই অধিকার কেড়ে নেওয়ায় একাধিক দেশীয় রাজ্যের রাজন্যবর্গ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। এছাড়া, দেশীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে ব্রিটিশদের সাক্ষরিত সকল চুক্তিকে মর্যাদা দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, মহাবিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় উত্তেজনার কারণটি বিচার করে, ব্রিটিশ রাজশক্তি ঘোষণা করে দিলেন, এর পর থেকে ব্রিটিশরা ভারতের ধর্মীয় ব্যাপারে নাক গলাবে না; ভারতীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে।

কেউ কেউ রানির এই ঘোষণাপত্রকে বলেন ‘ভারতীয় স্বাধীনতার ম্যাগনা কার্টা’। ১৮৫৮ থেকে ১৯০৫ সাল অবধি ভারতে ব্রিটিশ শাসন মোটামুটি দৃঢ়ভাবেই বলবৎ ছিল। সেযুগে মনে হত, ভারতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশদের শাসন কয়েক শতাব্দীকালব্যাপী স্থায়ী হতে চলেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এই শাসনের নানা দিকই ভারতে একটি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। আর তা থেকে ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে তীব্রতর।

নবজাগরণ

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের পিছনে মোটামুটি চারটি কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ভারতের একক প্রশাসনের অধীনে আসা; দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ রাজশক্তির অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে জনচেতনার জাগরণ; তৃতীয়ত, আধুনিক শিক্ষার বিকাশ; এবং চতুর্থত, হিন্দুদের সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব।

ভারত সরকার আইন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ভারত ব্রিটিশ রাজশক্তির অধীনস্থ হয়। তখন ছোটো ছোটো রাজনৈতিক বিভাগগুলির অবলুপ্তি ঘটে– আমাদের দেশ একটি একক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসন দেশে পরিকাঠামো, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে শুরু করে। এর ফলে সারা দেশের মানুষের মধ্যে একটা একত্ববোধের জন্ম হয়; আর তা থেকেই জন্ম নেয় আমাদের ভারতীয় জাতিচেতনা।

কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে ব্রিটেনের সমৃদ্ধিসাধন। ভারত ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে এলে সরকারের আর্থিক শোষণের মাত্রা তীব্রতম হয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিল্প-সংক্রান্ত বিকাশ। উচ্চহারে রাজস্ব আদায়ের ফলে কৃষিক্ষেত্রের অবস্থাও হয়ে দাঁড়ায় শোচনীয়। এই অবস্থায়, এম. জি. রাণাডে, দাদাভাই নওরোজি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ব্রিটিশ নীতির কুফলের দিকগুলি আমাদের সামনে তুলে ধরেন। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ নীতির এই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ব্রিটিশ রাজশক্তি সম্পর্কে ভারতবাসীর মোহভঙ্গে অনেকটা সাহায্য করে। এর ফলে স্বদেশীর প্রেরণা জাগে। যার ফলে দেশে শিক্ষার মুক্ত বিকাশের চাহিদাও অনুভূত হয়।

এদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি নানা ধারণার সঙ্গে সুপরিচিত হয়ে উঠি। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ঘুচে যায় ভারতবাসীর ভাষার ব্যবধান। দেশীয় সাহিত্য জন্ম দেয় এক ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় চেতনার। এই সময়ই আনন্দমঠ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা করেন স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটি। সংবাদপত্রও পিছিয়ে ছিল না। মাতৃভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিও একের পর এক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর স্বরূপটি দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত করে দিতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি তীব্র জনমত সংগঠিত হয়।

আধুনিক শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতিকর দিকগুলির অপসারণ ঘটিয়ে নতুন সমাজ গড়ে তোলার তাগিদ অনুভূত হয়। এর ফলে স্বধর্মের প্রতি হিন্দুদের বিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে আসে। আধুনিক হিন্দু বহু সহস্রাব্দ-প্রাচীন এই ধর্মকে নিয়ে গর্ববোধ করতে থাকেন। ব্রাহ্মসমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন, আর্যসমাজ প্রভৃতি সংগঠন ছিল এই সংস্কার আন্দোলনের পুরোভাগে।



নীলবিদ্রোহ

ব্রিটিশ আমলে ভারতে যতগুলি কৃষক আন্দোলন হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র ছিল ১৮৫৯-৬০ সালের নীলবিদ্রোহ। সেযুগে ইউরোপীয় নীলকর সাহেবরা তাদের নীল-কারখানার জন্য গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নীল উৎপাদনে বাধ্য করত। এর ফলে চাষিরা ইচ্ছা থাকলেও তাদের জমিতে কোনো অর্থকরী ফসলের চাষ করতে পারত না। এদিকে নীল চাষেও তারা উপযুক্ত দাম পেত না। উপরুন্ত নীলকরেরা তাদের নানাভাবে ঠকাত ও অত্যাচার করত। ১৮৫৯ সালের শরতে বাংলার নীল চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। নদিয়া জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে দুই নীলচাষি দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণু বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলচাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৮৬০ সালের মধ্যে বাংলার সব নীল-উৎপাদনশীল জেলায় নীলকর-বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। নীলকর সাহেবরা এতে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়, এবং শেষপর্যন্ত নীলব্যবসা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৮৬০ সালের শেষাশেষি বাংলায় নীলচাষ উঠে যায়।

বাংলার নীলকর-বিরোধী আন্দোলন সাফল্য পেয়েছিল চাষিদের সঠিক উদ্যোগ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও শৃঙ্খলাপরায়ণতার জন্য। হিন্দু ও মুসলমান চাষিরা ধর্মীয় ভেদ সরিয়ে রেখে একসঙ্গে নীলবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ধনী কৃষক, এমনকি কিছু জমিদার, মহাজন ও নীলকুঠির প্রাক্তন কর্মচারীও বিদ্রোহী নীলচাষিদের মদত দিয়েছিলেন। নীলবিদ্রোহের সমর্থনে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র, নাটকটির ইংরেজি অনুবাদক মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও প্রকাশক রেভারেন্ড জেমস লঙের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গোড়াপত্তন

১৮৮৫ সালে অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্ট অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল ইউনিয়ন। ১৮৮৮ সালে বোম্বাইয়ে এই দলের প্রথম অধিবেশন বসে। সেই অধিবেশনে দলটি সর্বভারতীয় স্বীকৃতি লাভ করে এবং নেতৃবর্গ এই দলের নাম পরিবর্তন করে ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেস বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাখেন। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দাদাভাই নওরোজি, বদরুদ্দিন তয়েবজি, আনন্দমোহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত, ফিরোজশাহ মেহতা, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, জি. সুব্রহ্মণ্য আইয়ার, বালগঙ্গাধর তিলক, মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ। কলকাতার বিশিষ্ট আইনজীবী উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধায়ের সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সারা দেশ থেকে ৭২ জন প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। এরপর থেকে প্রতি বছরই একবার করে কংগ্রেসের অধিবেশন বসত। ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে কংগ্রেস গভীর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।

প্রথম দিকে জাতীয় কংগ্রেস ছিল ক্ষুদ্র এক প্রতিষ্ঠান। এদের আন্দোলন পদ্ধতি ছিল সংশয়দীর্ণ ও নরমপন্থী। তাসত্ত্বেও বলতে হয়, জাতীয় কংগ্রেসের হাত ধরেই সংগঠিতভাবে নিয়মিত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। কংগ্রেসের নেতৃবর্গ ব্রিটিশ সরকারের ‘সৌজন্যবোধ ও মহত্বে’ ভরসা রাখতেন। তাই তাঁদের রাজনীতি চলত আবেদন-নিবেদনের নীতিতে। ব্রিটিশরা যতদিন না তাঁদের দমন করা শুরু করেছিল, ততদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য চরম আন্দোলন গড়ে তোলার কথা এঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। ১৮৯২ সালে ব্রিটিশরা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল আইন পাস করে সীমিত সংখ্যক ভারতীয়কে পরোক্ষভাবে আইনসভায় প্রবেশের অধিকার দেন। কিন্তু আইনসভাতে সুকৌশলে তাঁদের সংখ্যালঘু করে রাখা হয়। এতে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেই ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘটনার সময় কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃত্ব পড়ে প্রশ্নের মুখে।

ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার ইতিহাস

17
SEP
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও পরে ব্রিটিশ রাজ সরকার ভারতবাসীর শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কম-মাইনেতে ইংরেজি-শিক্ষিত কেরানির দল তৈরি করা।



১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা (অধুনা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) চালু করেন। ১৭৯১ সালে জোনাথান ডানকান বারাণসীতে একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা ও আদবকায়দা শেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় চালু করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।



১৮১৩ সালের চার্টার আইনে ভারতে শিক্ষাবিস্তারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্বের কথা প্রথম স্বীকার করা হয়। এই আইন মোতাবেক, ভারতীয়দের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়। এরপর ১৮১৭ সালে ডেভিড হিউম কলকাতা হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপন করেন।



১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষাকে ভারতের উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘উড’স ডেসপ্যাচ অন এডুকেশন’। চার্লস উডের এই ‘ডেসপ্যাচ’কেই ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা আখ্যা দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষার একটি যুক্তিসঙ্গত পাঠক্রম নথি আকারে প্রকাশ করেন। এই নথিতে প্রাথমিক স্তরে, মাধ্যমিক স্তরে এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে কিভাবে কি পড়ানো হয়ে তার বিভাগ করে দেন তিনি। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি এবং প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করা হয়। দেশীয় ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইঙ্গ-দেশীয় ভাষা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও অনুমোদিত কলেজগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। নারীশিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে ঘরোয়া পরিবেশে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষক-প্রশিক্ষণের জন্যও উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বও স্বীকৃতি পায়। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।



হান্টার কমিশন ১৮৮২-৮৩

ওয়ার্ডসের আবেদনের ভিত্তিতে লর্ড রিপন ভারত সরকারের শিক্ষানীতি পুনরালোচনার জন্য এক সদস্যের হান্টার কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন জানায়, প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা, সাক্ষরতা ও বাণিজ্য শিক্ষার বিস্তারেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হান্টার কমিশন। শুধু তাই নয়, হান্টার নারীশিক্ষা বিস্তার ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপের জন্যও সুপারিশ করেছিলেন। এরপর ১৮৮২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।



ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪

লর্ড কার্জনের আমলে ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস ও কার্যকর হয়। ১৯০১ সালে সিমলা শিক্ষা সম্মেলনের পর লর্ড কার্জন শিক্ষাক্ষেত্রে স্যার টমাস র্যালে কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই আইন পাস হয়। উক্ত কমিশনে একজন ভারতীয় সদস্যও ছিলেন। তিনি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আইন চালু হওয়ার পর সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোদের মনোনীত করার অধিকার পায়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের ভেটো প্রয়োগের অধিকারও স্বীকৃত হয়। বেসরকারি কলেজগুলির উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব শুরু হয়। ফেলোদের সদস্যসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার-এলাকা ও অনুমোদিত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার জন্য গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে ক্ষমতা দেওয়া হয়।



স্যাডলার কমিশন, ১৯১৭-১৯

১৯০৬ সালে দেশীয় রাজ্য বরোদায় রাজার আদেশ বলে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম পর্যালোচনার জন্য গঠিত হয় স্যাডলার কমিশন। এই কমিশনের দুজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ। ১৯১৯ সালে স্যাডলার কমিশন উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রস্তাব রাখেন। স্যাডলার কমিশন সুপারিশ করেন, ইন্টারমিডিয়েটের পর ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স রাখা উচিত, নারীশিক্ষায় আরও গুরুত্ব আরোপ করা উচিত, শিক্ষক-প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করা উচিত, এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকা উচিত এবং আবাসিক ও বোর্ডিং সুবিধাযুক্ত হওয়া উচিত।



হার্টোগ কমিশন, ১৯২৯

হার্টোগ কমিশন জাতীয় স্তরে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বের কথা বলে। এই কমিশন তহবিল সঞ্চয় ও উন্নয়ন নীতির উপর জোর দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়।



বুনিয়াদি শিক্ষাক্ষেত্রে ওয়ার্ধা পরিকল্পনা, ১৯৩৭

১৯৩৭ সালে মহাত্মা গান্ধী হরিজন পত্রিকায় একগুচ্ছ নিবন্ধ প্রকাশ করে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ পরিকল্পনার প্রস্তাব দেন। এই পরিকল্পনা বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা বা ওয়ার্ধা স্কিম নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনার মূল কথা ছিল কাজের মাধ্যমে শিক্ষা। জাকির হুসেন কমিটি এই পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করেন এবং কয়েকটি কোর্সের জন্য পাঠক্রম তৈরি করেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, পর্যালোচনা, পরীক্ষা ও শিক্ষাপ্রশাসন পরিচালনা সংক্রান্ত একগুচ্ছ প্রস্তাবও দেন।



সারজেন্ট পরিকল্পনা, ১৯৪৪

এই পরিকল্পনা ভারতে বুনিয়াদি শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের উপর জোর দেয় এবং ৬-১১ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সর্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষাদানের কথা বলে। এই পরিকল্পনায় ৬ বছরের বিদ্যালয় পাঠক্রমের সুপারিশ করা হয়। উচ্চ বিদ্যালয়গুলিকে (১) আকাদেমিক ও কারিগরি ও (২) ভোকেশনাল—এই দুই ভাগে ভাগ করার কথা বলা হয়। এই পরিকল্পনাতেই ইন্টারমিডিয়েট স্তর অবলুপ্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। সারজেন্ট পরিকল্পনায় ৪০-বছরের শিক্ষা-সংস্কার পরিকল্পনার উপর জোর দেওয়া হয়। পরে খের কমিটি এই সংস্কার পরিকল্পনার সময়কাল কমিয়ে ১৬ বছর করে।
সূত্র: বঙ্গভারতী

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here
Top